এত বড় নাম, তাই শর্টকাটে ডাকার জন্য তার নাম দিয়েছিলাম সুর। ওর সাথে পরিচয়ের গল্পটা অদ্ভুত। আমার দুই বন্ধু নাহিদা আর ইকরু। সিলেটের নয়াসড়কে সিপ কফিতে পান করে হেলেদুলে শিল্পকলায় যাচ্ছিলাম। নাট্যগুরু ভবতোষ রায় বর্মণ সকালেই বাজখাই গলায় নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘বাঘের শিন্নি আবার নামাচ্ছি, বিকেলবেলা রিহার্সেলে চলে আসেন।’ আমাদের নাটকের নাম বাঘের শিন্নি। সেখানে রাখাল রাজা চরিত্রে আমি অভিনয় করি। তো রিহার্সেলে ঢুকেই দেখি এক ছেলে ম্যানমেনিয়ে কথা বলে। আমি দিলাম এক ধমক, ‘অই মিয়া জোড়ে কথা বলতে পারেন না? খাইয়া আসেন নাই নাকি?’ কে জানি পাশ থেকে বললো, ‘ভাই এইডা বিদেশি, বাংলায় কথা বলতে পারে না।’ একটু আশ্চর্য হলাম।
—দেখতে তো আমাদের মতোই লাগছে। কোন দেশ, ইন্ডিয়া না নেপাল?
—না ভাই। আরব দেশ থেইক্যা আইছে, ওমানিজ।
—খাইছে আমারে, কাইফা হালুকা।
সেদিন ধমক খেয়ে ফেসবুকে সে আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়। তারপর থেকেই আমাকে মেসেঞ্জারে প্রতিবেলা নক করতো। দেখা হলে ‘দাদা দাদা’ বলে মুখে ফেনা তুলতো। ভবতোষ স্যার একদিন চুপি চুপি ডেকে নিয়ে বললেন, ‘একে বাঙালি বানাতে হবে।’ স্যারের পরামর্শে দ্বিগুণ উত্সাহে সুরকে বাঙালি বানানোর প্রজেক্ট শুরু হলো। আমার যত কাজকর্ম আছে সবকিছুতেই সুরকে যুক্ত করলাম। আমি, আমার বন্ধু-বান্ধব, আমার সংগঠন কাকতাড়ুয়া, আমার ক্যাম্পাস, আমার পরিবার সবকিছুর সাথে সুরকে জড়িয়ে নিলাম। আইএমও (ইমু) নামে একটা কথা বলার সফটওয়ার আছে। ১ মিনিট পরপরই আমাদের ইমুতে যোগাযোগ হতো। জীবনের বন্ধু তালিকায় নতুন বন্ধু সুরঞ্জন দাস।
২০১৭ সালের বন্ধু দিবস। সিলেটে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজ কি আমাদের দেখা হবে?’ সে বললো, ‘ইউ আর মাই ফ্রেন্ড। টুডে ইজ ভেরি স্পেশাল ডে। উই শ্যুড মিট।’ আমার কাছে বন্ধু দিবস অত আহামরি কিছু ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন ছাড়ার পর সব বন্ধুরা যে যার ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। সবচেয়ে কাছের বন্ধুও বিদেশ চলে গেছে। তবে ঘৃণাভরা পৃথিবীতে একজন মানুষের সাথে আরেকজন ভালো সম্পর্ক দেখলে ভালো লাগে। তো বন্ধু দিবসের দিন রিহার্সেল শেষ করে সব শিল্পীদের নিয়ে একটা টং-এ বসে চা খাচ্ছিলাম। সবাই চলে যাওয়ার পর সুর আমাকে একটা চকোলেটের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে শুভেচ্ছা জানালো। যাওয়ার সময় জড়িয়ে ধরে বললো, ‘হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে।’ সেই থেকে গত ১ বছর ধরে প্রতিদিন বিদায় নেওয়ার সময় সে আমাকে জড়িয়ে ধরে। সন্তান বহুদূর গেলে মা যেভাবে অশ্রুসজল নয়নে বিদায় দেয়, বছরের পর বছর পড়িয়ে স্কুল মাস্টারকে ছাত্ররা মানপত্র পড়িয়ে যেভাবে বিদায় দেয়, অষ্টাদশী মেয়েকে বিয়ের সময় বরের হাতে তুলে দিয়ে পরিবার যেভাবে বিদায় দেয়, আমাদের প্রতিদিনের বিদায় পর্বটা এ রকম ছিল। কাল সকালেই আমাদের দেখা হতো অথচ আজ মাঝরাতের বিদায়টা যেন মেনে নিতে চাইতাম না। আসলে আমাদের কথা ফুরাতো না। দুটি ভিন্নদেশি মানুষের গত ২৮ বছরের দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন ভাষার গল্প।
আগস্টের ১০ তারিখ বন্ধুরা মিলে খাদিমনগর রিজার্ভ ফরেস্টে ক্যাম্প ফায়ার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তাবু টানিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে জঙ্গলের মাঝে রাত কাটানো। আহা জীবন, কত উপভোগ্য! মাঝরাতে খবর এলো আমার দাদী মারা গেছেন। ওই মুহূর্তে সুর যেভাবে আমাকে সাপোর্ট দিলো তা আমি কখনো ভুলবো না। চারদিকে অন্ধকার। যেকোনো মুহূর্তে জঙ্গলের বাঘ-ভাল্লুক এসে আমাদের তাবুতে হানা দিতে পারে। খাদিমনগর জঙ্গলে অজগর সাপ আর কালো গোখড়ার ছড়াছড়ি। সিলেটে তখন খুব বৃষ্টি। দাদীর লাশ দেখতে আমি বাড়ি পর্যন্ত যাইনি। এমন এক সঙ্কটময় মুহূর্তে দুটি প্রাণী জীবনের গল্প শুরু করে। বিপদে যে পাশে থাকে, সেই না সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সুর আমার বিপদের বন্ধু। এক সময় আশা জাগানিয়া ভোর হয়। জন্ম নেয় নতুন একটি সম্পর্ক। মানুষ জানলে অবাক হবে আমরা প্রতিমাসের ১০ তারিখ ‘হ্যাপি টেন’ নামে বন্ধু দিবস পালন করি। শুনতে পাগলামি মনে হলেও এটাই সত্য।
সুরকে বাংলাদেশ ও বাংলা সংস্কৃতি চেনানো শুরু করলাম। প্রতিদিন কথায় কথায় বাংলাদেশ টেনে আনতাম। রিকশার মধ্যে গলা ছেড়ে বাউল গান গাইতাম, ওকেও বলতাম, ‘ধরো আমার সাথে।’ সেও আনমনে গাইতো, ‘আমারে ছাড়িয়ারে বন্ধু যাইও না। তোমার লাগি পরান কান্দে ঘরে মন বসে না।’ কত রাত রাস্তায় বসে বসে গল্প করেছি হিসেব নেই। সে চমত্কার গিটার বাজায়। গিটার হাতে একসাথে বসলে দু’জন মিলে গান হবেই হবে।
সারা সিলেট শহরে অলিগলিতে সুরকে নিয়ে বিচরণ। লক্ষ্য করলাম তার অতীত খুব একটা সুবিধার না। ওমানের সালালাহ শহরের পাকিস্তানি স্কুলে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তো। বাবা-মা বাঙালি হলেও এই ভদ্রলোকের বাংলাদেশ নিয়ে খুব একটা পজিটিভ চিন্তা নেই। মুখে শুধু ওমান আর পাকিস্তান, সালালাহ আর করাচি! এ জন্য তাকে আমি ডাকতাম ‘রাজাকার’। একদিন রাজাকাররা কত খারাপ কাজ করেছে তার বিবরণ দিয়েছিলাম, তারপর সে কেমন জানি একটু বদলালো। ডিসেম্বরে তাকে আমি একটা বাংলাদেশের পতাকা উপহার দিয়েছিলাম। সে পতাকা মাথায় বেঁধে সিলেট শহীদ মিনারে রাত ১২টায় এসে শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে মোমবাতি জ্বালালো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফুল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানালো। আমার সাথে নন্দিতা সিনেমা হলে গিয়ে গেরিলা মুভি দেখলো। তারপর এলো একুশ, একুশে ফেব্রুয়ারি। ততোদিনে সুর আর আমার মধ্যে চমত্কার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে সে একটা পুরো বাংলা গান শিখেছে। রাত ৪টায় সেই গান রেকর্ড করে আমার কাছে পাঠিয়েছে। কি যে ভালো লেগেছিল! দিনদিন সে বাংলাকে ধারণ করছে।